Friday, September 30, 2016

বাক্য প্রকরণ



 বাক্য
কতোগুলো পদ সুবিন্যস্ত হয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করলে তাকে বাক্য বলে
বাক্যে কতোগুলো পদ থাকে। শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হলে তাকে পদ বলে। এই বিভক্তি যুক্ত হয়ে শব্দগুলো পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে বাক্য গঠন করে। নয়তো বাক্য তৈরি হয় না। যেমন- আমা মা আমা অনেক আদর করে। এখানে মূল শব্দগুলো বিভক্তি ছাড়া সঠিক ক্রমে (ড়ৎফবৎ) সাজানো হলেও একটির সঙ্গে আরেকটি শব্দের কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। শব্দগুলোতে বিভক্তি যুক্ত করলে একটি সম্পূর্ণ বাক্য তৈরি হবে- আমার মা আমাকে অনেক আদর করে
ভাষার মূল উপকরণ বাক্য, বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। আর ভাষার মূল উপাদান ধ্বনি
ভাষার বিচারে/ব্যাকরণ অনুযায়ী একটি সার্থক বাক্যের ৩টি গুণ থাকতেই হবে/আবশ্যক- আকাঙক্ষা, আসত্তি, যোগ্যতা
আকাঙক্ষা
বাক্যে সম্পূর্ণ একটি মনোভাব থাকতে হবে। বাক্যের ভাব বা বক্তার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকলে সেটি বাক্য হবে না। যেমন- মা আমাকে অনেক
বা মা আমাকে অনেক আদর
উপরের কোন বাক্যই বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ করছে না। দুটি বাক্য শেষ হওয়ার পরও আরো কিছু শোনার আকাঙক্ষা থেকে যাচ্ছে। সুতরাং, কোন বাক্যেরই আকাঙক্ষা গুণটি নেই। তাই কোনটিই বাক্য নয়। সম্পূর্ণ বাক্যটি হবে-
মা আমাকে অনেক আদর করে
এটি শোনার পর আর কিছু শোনার আগ্রহ বাকি থাকছে না। সুতরাং এটি আকাঙক্ষা গুণ সম্পন্ন একটি সার্থক বাক্য
অর্থাৎ, শ্রোতার সম্পূর্ণ বাক্য শোনার আগ্রহ- আকাঙক্ষা
আসত্তি
বাক্যের পদগুলোকে সঠিক ক্রমে/ অর্ডারে না সাজালে সেটি বাক্য হয় না। উপরের বাক্যের পদগুলো অন্যভাবে সাজালে সেটি বাক্য নাও হতে পারে। যেমন, উপরের বাক্যকে যদি এভাবে সাজানো হয়-
আমার অনেক মা আদর আমাকে করে
এখানে বাক্যের প্রকৃত অর্থ যেমন বিকৃত হয়ে গেছে, তেমনি বিকৃত অর্থও পরিস্কার ভাবে প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং, বাক্যের পদগুলোকেও সঠিক ক্রমানুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। বাক্যের এই বিন্যাসকেই আসত্তি বলে। উপরের বাক্যটিকে সঠিক ক্রমে সাজালে হবে-
আমার মা আমাকে অনেক আদর করে।
এখানে বাক্যের পদগুলোর বিন্যাস বাক্যটির অর্থ সঠিক পরিস্কারভাবে প্রকাশ করছে। সুতরাং এটি আসত্তি গুণ সম্পন্ন একটি সার্থক বাক্য
অর্থাৎ, বাক্যের পদগুলোকে সঠিক ক্রমে (Order) বিন্যস্ত করে বক্তার মনোভাব সঠিক পরিস্কার করে বোঝানোর কৌশলই আসত্তি গুণ
যোগ্যতা
বাক্যের অর্থ সঠিক পরিস্কার করে বোঝাতে আকাঙক্ষা আসত্তি গুণ ছাড়াও আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। বাক্যের পদগুলো যদি পরস্পর অর্থগত ভাবগত দিক দিয়ে সম্পর্কিত না হয়, তাহলেও সেটি সার্থক বাক্য হয় না। যেমন-
গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে পলাবনের সৃষ্টি হয়েছে।
বাক্যটিতে আকাঙক্ষা গুণও যেমন আছে, তেমনি এতে আসত্তি গুণও আছে। কিন্তু বাক্যটি সার্থক বাক্য নয়। কারণ, গ্রীষ্মে বৃষ্টিই হয় না। সুতরাং, সেই বৃষ্টিতে পলাবনের প্রশ্নই আসে না। সুতরাং, বাক্যের পদগুলোর মধ্যে অর্থগত এবং ভাবগত কোনই মিল নেই। বাক্যটি যদি এভাবে লেখা হয়-
বর্ষার বৃষ্টিতে পলাবনের সৃষ্টি হয়েছে।
তাহলে বাক্যটির পদগুলোর মধ্যে অর্থগত ভাবগত মিল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এটি একটি যোগ্যতা গুণ সম্পন্ন সার্থক বাক্য
অর্থাৎ, বাক্যের শব্দগুলোর অর্থগত ভাবগত মিলকেই যোগ্যতা বলে
বাক্যের যোগ্যতার ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো জড়িত-
) গুরুচণ্ডালী দোষ : সংশিলষ্ট দুটি শব্দের একটি তৎসম একটি তদ্ভব শব্দ ব্যবহার করলে সেটি বাক্যের যোগ্যতা গুণ নষ্ট করে। কারণ, তাতে পদগুলোর ভাবগত মিল নষ্ট হয়। একে গুরুচণ্ডালী দোষ বলে
যেমন- ‘গরুর গাড়িশব্দদুটো সংশিলষ্ট শব্দ এবং দুটিই খাঁটি বাংলা শব্দ। আমরা যদি একেগরুর শকটবলি, তা শুনতে যেমন বিশ্রী শোনায়, তেমনি শব্দদুটোর ভাবগত মিলও আর থাকে না। এটিই গুরুচণ্ডালী দোষ। এরকম- ‘শবদাহকেমড়াদাহকিংবাশবপোড়া’, ‘মড়াপোড়াকেশবপোড়াবামড়াদাহ’, বললে তা গুরুচণ্ডালী দোষ হবে।
অর্থাৎ, বাক্যে তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ তদ্ভব বা খাঁটি বাংলা শব্দ একসঙ্গে ব্যবহার করলে তাকে গুরুচণ্ডালী দোষ বলে
) বাহুল্য দোষ : প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ বা শব্দাংশ ব্যবহার করলে শব্দের অর্থগত যোগ্যতা নষ্ট হয়। ফলে বাক্যও যোগ্যতা গুণ হারায়।
শব্দকে বহুবচন করার সময় একাধিক বহুবচনবোধক শব্দ বা শব্দাংশ ব্যবহার করা একটি সাধারণ বাহুল্য দোষ। অধিক জোর দেয়ার জন্য অনেক সময় এই কৌশল প্রয়োগ করা হলেও সাধারণ ক্ষেত্রে একাধিক বহুবচনবোধক শব্দ বা শব্দাংশ ব্যবহার করলে শব্দটি বাহুল্য দোষে দুষ্ট হয়। যেমন- ‘সব মানুষেরাবাহুল্য দোষে দুষ্ট শব্দ। যোগ্যতা গুণ সম্পন্ন বাক্যেসব মানুষবামানুষেরা’- এই দুটির যে কোন একটি ব্যবহার করতে হবে
) উপমার ভুল প্রয়োগ : উপমা-অলংকার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এগুলোর প্রয়োগে কোন ভুল হলে বাক্য তার ভাবগত যোগ্যতা হারাবে। যেমন-
আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হল।
বাক্যটিতে উপমার ভুল প্রয়োগ হয়েছে। কারণ, বীজ মন্দিরে উপ্ত হয় না/ বপন করা হয় না। বীজ বপন করা হয় ক্ষেতে। সুতরাং বলতে হবে-
আমার হৃদয়-ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হল
) বাগধারার শব্দ পরিবর্তন : বাগধারা ভাষার একটি ঐতিহ্য। বাংলা ভাষাতেও অসংখ্য বাগধারা প্রচলিত আছে। এসব বাগধারা ব্যবহার করার সময় এগুলোর কোন পরিবর্তন করলে বাগধারার ভাবগত যোগ্যতা নষ্ট হয়। ফলে বাক্য তার যোগ্যতা গুণ হারায়। সুতরাং, যোগ্যতা সম্পন্ন সার্থক বাক্য তৈরি করতে বাগধারা সঠিকভাবেই লিখতে হবে
যেমন- যদি বলা হয়, ‘অরণ্যে ক্রন্দন’, তাহলে গুরুচণ্ডালী দোষও হয় না। কিন্তু বাগধারাটির শব্দ পরিবর্তন করার কারণে এটি তার ভাবগত যোগ্যতা হারিয়েছে। যোগ্যতা সম্পন্ন বাক্য গঠন করতে হলে প্রচলিত বাগধারাটিই লিখতে হবে। অর্থাৎ, ‘অরণ্যে রোদন লিখতে হবে
) দুর্বোধ্যতা : অপ্রচলিত কিংবা দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্য তার যোগ্যতা গুণ হারায়। এই ধরনের শব্দ বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে অর্থগত মিলবন্ধন নষ্ট করে। যেমন-
কী প্রপঞ্চ!
বাক্যটির প্রপঞ্চ শব্দটি অপ্রচলিত, একই সঙ্গে দুর্বোধ্য। তাই বাক্যটির অর্থ পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। ফলে বাক্যের পদগুলোর মধ্যের অর্থগত মিলবন্ধন বিনষ্ট হয়েছে। তাই এটি কোন যোগ্যতা সম্পন্ন সার্থক বাক্য হতে পারেনি
) রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা : বাক্যে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, শব্দগুলো যাতে তাদের রীতিসিদ্ধ অর্থ অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ব্যবহারিক বা রীতিসিদ্ধ অর্থ ভিন্ন হলে, অবশ্যই রীতিসিদ্ধ অর্থে শব্দ ব্যবহার করতে হবে। নয়তো শব্দটির সঙ্গে বাক্যের অন্য শব্দগুলোর অর্থগত মিলবন্ধন নষ্ট হবে। যেমন-
বাধিতশব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থবাধাপ্রাপ্ত আর ব্যবহারিক বা রীতিসিদ্ধ অর্থ হলোকৃতজ্ঞ শব্দটি ব্যবহারের সময় কৃতজ্ঞ অর্থেই ব্যবহার করতে হবে। নয়তো তা অর্থ বিকৃত করবে। ফলে বাক্যটি যোগ্যতা গুণ হারাবে